আখ আমাদের দেশের খাদ্য ও শিল্পে ব্যবহার্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থকরী ফসল। চিনি, গুড় ও চিবিয়ে খাওয়ার জন্য আখ ফসল চাষ করা হয়ে থাকে। আখ একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল, যা জমিতে প্রায় ১৩-১৪ মাস থাকে। দেশে খাদ্যাভাব যখন কম ছিল, তখন আখ চাষ বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু দিন দিন খাদ্য শস্যসহ অন্যসব জিনিসের বাজারমূল্য অনেক বেড়ে গেছে। অথচ তুলনামূলকভাবে আখের মূল্য না বাড়ার কারণে কৃষক ভাইয়েরা আখ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। উচ্চফলনশীল ও স্বল্পসময়ে চাষ করা যায় এমন ফসল চাষ করে বেশি আয় করার ফলে ক্রমশ আখ চাষের জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। সাথে সাথে তুলনামূলকভাবে নি¤œমানের জমিতে আখের চাষ করা হচ্ছে। ফলে আখের ফলন দিনকে দিন কমেই যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে সার্বিকভাবে দেশের চিনি শিল্পের ওপরে।
তাই আখ ফসলকে এ বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনার। কারণ আখ ফসল জমিতে প্রায় ১৩ থেকে ১৪ মাস অবধি থাকে, তাই দীর্ঘ সময়টি আমাদের সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। আর সে কারণেই আমাদের আখের সাথে যাতে করে, আরেকটি স্বল্পমেয়াদি ফসল সুষ্ঠুভাবে চাষ করতে পারি, সে ব্যবস্থাও জনপ্রিয় করতে হবে।
আখের সাথে সাথি ফসল হিসেবে আমরা ডাল জাতীয় ফসলের মধ্যে মটরশুঁটি, ছোলা, মশুর, মুগ ইত্যাদি। মসলা জাতীয় ফসলের মধ্যে পেঁয়াজ, রসুন ও তেল ফসলের মধ্যে তিল, তিসি, সরিষা, বাদাম ইত্যাদি চাষ করতে পারি।
আখের সাথে সাথি ফসলের চাষের কারণগুলো হলো
* আখের সাথে সাথি ফসল হিসেবে ডালজাতীয়, তেলজাতীয় ফসলগুলো আলাদা জমি ছাড়াই বিনা সেচে বৃষ্টিনির্ভর অবস্থায় চাষ করা যায়, যা এককভাবে আখ চাষের চেয়ে অনেক লাভজনক।
* সাথি ফসল পরিচর্যার সময় আখের আংশিক আন্তঃপরিচর্যার কাজও হয়ে যায়।
* ডাল ফসলের গাছ ছোট, পাতা কম সেজন্য আখের সাথে এর পুষ্টি এবং অন্যান্য বিষয়ে প্রতিযোগিতা কম।
* সাথি ফসল হিসেবে ডালজাতীয় ফসল চাষে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়।
* এছাড়াও আখের সাথে সাথি ফসল হিসেবে পেঁয়াজ রসুন চাষ করলে অতি অল্প সময়ে অতিরিক্ত একটি ফসল পাওয়া যায়।
* সাথি ফসল চাষে জমির ব্যবহার বৃদ্ধি ও জাতীয় উৎপাদন বেড়ে যায়।
* পেঁয়াজ ও রসুনের গাছ ছোট, পাতা কম ও সরু এবং গুচ্ছ মূলের পরিধি সীমিত হওয়ায়, আখের সাথে এদের মাটি থেকে পুষ্টি নিতে তেমন কোনো প্রতিযোগিতা হয় না।
* প্রাকৃতিক দুর্যোগে আখ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সাথি ফসল থেকে আংশিক ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়।
* পেঁয়াজ ও রসুনের পাতায় তীব্র ঝাঁঝ থাকায় সাথি ফসল হিসেবে আখ চাষ করলে আখে পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হয়।
* আখের সাথে সাথি ফসল চাষ করলে জমিতে আগাছা কম হয় ফলে মূল ফসলের ফলন অনেকাংশে বেড়ে যায়।
আখের সাথে সাথি ফসল হিসেবে ডাল ফসল চাষ
আখের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আখের জমিতে সাথি ফসল হিসেবে ডাল ফসল চাষ করতে পারি। আখের সাথে ডাল প্রথম এবং দ্বিতীয় সাথি ফসল হিসেবে চাষ করা যায়। প্রথমবার সাথি ফসল হিসেবে চাষ করার জন্য কার্তিক মাস থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত আখের বীজ বা চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। আবার দ্বিতীয়বার চাষের জন্য মার্চ/এপ্রিল মাসে অনায়াসে ডাল ফসল চাষ করা যায়। আখের দুই সারির মাঝে ডাল ফসলের বীজ সারি করে বুনে দিতে হবে। ভালো ফলনের জন্য পরিচর্যার সময় আখ ফসলের আন্তঃপরিচর্যার কাজ হয়ে যায়।
জমি নির্বাচন
দো-আঁশ, বেলে দো-আঁশ ও এঁটেল দো-আঁশ মাটি আখ চাষের জন্য খুবই ভালো।
চারা রোপণ : আখ ফসলের দুই সারির মাঝ খানের মাটি কোদাল দিয়ে কুপিয়ে বা নিড়ানির সাহায্যে আলগা করে নিতে হবে এবং আগাছা থাকলে তা পরিষ্কার করে দিতে হবে। ডাল বীজ ৮-১০ ঘণ্টা ভিজিয়ে নিতে হবে। ডাল বীজের গায়ের পানি ভালোভাবে শুকিয়ে গেলে যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি ডালবীজ নির্ধারিত দূরত্বে বুনে দিতে হবে।
পরিচর্যা
ডাল ফসলের তেমন পরিচর্যা করার দরকার হয় না। তবে আগাছা দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার করে দিতে হবে। ডালের চারা গজানোর পর নির্দিষ্ট দূরত্বে চারা রেখে বাড়তি ঘন চারা তুলে পাতলা করে দিতে হবে। তবে ছোলার ডালপালা এমনিতেই বেশি হয়, সেজন্য বীজ একটু পাতলা করে বুনলেও কোনো ক্ষতি নেই।
রোগবালাই দমন
ডাল ফসলের মধ্যে মসুর ও ছোলার সাধারণত জাব পোকা ও ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ দেখা যায়। জাব পোকার আক্রমণ হলে কেরোসিন মেশানো ছাই ছিটিয়ে এ পোকা দমন করা যায়। আক্রমণের মাত্রা বেশি হলে কেবলমাত্র তখনই অনুমোদিত কীটনাশক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। তবে ডাল ফসলের ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণ হলে থিয়ন গ্রুপের কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। আবার মুগ ডালে বিছা পোকার আক্রমণ হলে কেরোসিন মেশানো দড়ি ক্ষেতের ওপর দিয়ে টেনে দিলে আক্রমণের মাত্রা অনেকটাই কমে যায়। আক্রমণ বেশি হলে ম্যালাথিয়ন ও ডায়াজিনন গ্রুপের যে কোনো কীটনাশক স্প্রে করে দমন করতে পারেন। গোড়া পচা রোগ দেখা দিলে ব্যাভিস্টিন স্প্রে করে দমন করতে হবে।
সার প্রয়োগ
আখ ফসলের সঙ্গে সঙ্গে সাথি ফসল চাষে অতিরিক্ত কোনো সার প্রয়োগের প্রয়োজন নেই।
আখের সঙ্গে মসলা ফসল চাষ
আখ চাষ উপযোগী বেলে দো-আঁশ ও পলি দো-আঁশ মাটিতে পেঁয়াজ ও রসুন চাষ ভালো হয়। যেসব জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকে এবং রস ধারণ ক্ষমতা বেশি সেসব জমিতে পেঁয়াজ ও রসুন চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যেতে পারে। তবে জমিতে পানি সেচ ও নিকাশের সুব্যবস্থা থাকতে হবে।
জমি তৈরি
দুই সারি আখের মাঝের খালি জায়গার মাটি কুপিয়ে ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। তারপর প্রয়োজনীয় পরিমাণে গোবর সার এবং অন্যান্য রাসায়নিক সার ছিটিয়ে তা ভালোভাবে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। আখের আগাম জাতের সাথে রসুন ও পেঁয়াজ কন্দ এবং মধ্য নাবি জাতের আখের সঙ্গে চারা পেঁয়াজ লাগানো যাবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব ১৫ থেকে ২০ সেমি. এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৮ থেকে ১০ সেমি.। দুই সারি আখের মধ্যে পাঁচ সারি পেঁয়াজ বা রসুন লাগানো যাবে। এছাড়া ধনিয়ার বীজও জমি তৈরির সময় শেষ চাষের আগে ছিটিয়ে বুনতে পারেন। আবার দুই সারির মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় সারি করেও ধনিয়ার বীজ বুনতে পারেন।
পরিচর্যা
পেঁয়াজ ও রসুন লাগানোর পর আগাছা পরিষ্কার, উপরি সার প্রয়োগ, পানি সেচ ও নিকাশ এবং রোগবালাই দেখা গেলে সময়মতো সঠিক নিয়মে দমনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। আখ, পেঁয়াজ ও রসুন ক্ষেতের যত্ন-পরিচর্যার কাজ এক সঙ্গেই করা সম্ভব। জমিতে রসের অভাব হলেই পানি সেচ দেয়ার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে পানি নিকাশের ব্যবস্থাও করতে হবে। পানি সেচ দেয়ার পর জমিতে ‘জো’ এলে বিশেষ করে পেঁয়াজ ও রসুন ক্ষেতে নিড়ানি দিয়ে মাটির চটা ভেঙে দিতে হবে। সাথি ফসল হিসেবে পেঁয়াজ ও রসুন চাষে বাড়তি কোনো উপরি সার দেয়ার প্রয়োজন হয় না। কারণ মূল ফসল আখে যে সারটা ব্যবহার করা হয় তাতেই এ ফসল দুইটির কাজে লাগে। পেঁয়াজ ফসলে থ্রিপস পোকার আক্রমণ হতে পারে। এছাড়া পার্পল ব্লচ ও লিফ ব্লাইট নামে মারাত্মক রোগ হতে পারে। পোকা ও রোগের আক্রমণ হলেই অনুমোদিত কীটনাশক অথবা ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে দমনের ব্যবস্থা করতে হবে।
এছাড়াও আপনি আখের সঙ্গে তেল ফসল হিসেবে সরিষা, রাই, তিল, তিসি, সূর্যমুখী এগুলোর চাষ করতে পারেন। এজন্য আলাদাভাবে জমি তৈরির প্রয়োজন হয়না। আখ লাগানোর আগে শেষ চাষের সময় পরিমাণ মতো বীজ বুনে দিতে পারেন। আবার আখের দুই সারির মাঝখানের ফাঁকা জায়গাতে সারি করেও বীজ বুনতে পারেন। আখের সঙ্গে কি ধরনের সাথি ফসলের চাষ করতে পারব সে বিষয়ের আলোচনাগুলো যথাযথভাবে মেনে সাথি ফসলগুলোর চাষ করতে পারি, তাহলে একদিকে যেমন আখের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারব, তেমনি পাশাপাশি দেশের চিনি, গুড় অন্যান্য ডাল, তেল ও মসলার ঘাটতি অনেকটাই পূরণে সহায়ক হবে।
মো. দেলোয়ার হোসেন*
*টেকনিক্যাল পার্টিসিপেন্ট, কৃষি তথ্য সার্ভিস, রাজশাহী